ভাগ্যান্বেষণ
–বিশ্বদীপ মুখার্জী
সকাল হতে না হতেই হাতে এক থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নিখিলেশ দাসগুপ্ত। তাঁর গন্তব্য স্টেশন। বেরোবার আগে স্ত্রী শান্তা দেবীকে এক কাপ চা করে দিলেন তিনি। চা খেয়ে পুনরায় বিছানায় শুয়ে শান্তা দেবী নিজের স্বামীকে বললেন – ‘কিছু খেয়ে যেতে পারতে তো।’
‘না গো। দেরি হয়ে গেলে মুশকিল। দুয়েকটা বাবু আছেন যারা রোজ সকালে আমার কাছে আসেন। তারা চলে গেলে অসুবিধে হবে। আমি ঠিক দশটায় চলে আসবো।’
টিটাগড় স্টেশনটা খুব বড় না হলেও সকাল থেকে লোকেদের প্রাচুর্য থাকে। শিয়ালদা যাওয়ার লোকাল ট্রেনগুলোতে ভিড় দেখবার মতো। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় ছোট্ট আসন পেতে বসলেন নিখিলেশ বাবু। তখন ঘড়ি তে সকাল প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে। পাশের চায়ের দোকানের দোকানিটা একবার আড়চোখে নিখিলেশ বাবুকে দেখে বিড়বিড় করে বলল – ‘কত বার বলেছি যে এই রোদে ছাতা নিয়ে আসতে। বুড়ো মানুষ, রোদ লেগে কিছু হয়ে গেলে আমাদেরই বিপদ। দোকান ছেড়ে হাসপাতাল নিয়ে দৌড়াতে হবে।’
দোকানির কথা হয়তো নিখিলেশ বাবুর কানে গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন – ‘চিন্তা নেই শ্যামল। এই বুড়োর এখন কিছু হবে না। বয়স আশির ওপরে হলে কি হবে, শরীরে এখনও ক্ষমতা তোমাদের থেকে অনেক বেশি।’
বুড়োর কথার সত্যতা প্রমাণের প্রয়োজন নেই সেটা শ্যামল খুব ভালোই বোঝে। জীবনে ঝড় জল কম গেল না নিখিলেশ বাবুর। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে মানুষ করলেন। একটি ছেলে। ভালো সরকারি চাকরিও পেল। রোজ সকালে টিটাগড় থেকে লোকাল ট্রেনে চড়ে শিয়ালদা যেত। কিছু দিন চাকরি করার পর এক দিন অফিস যাওয়ার সময় ভিড় ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে নিজের প্রাণ হারায়। বজ্রাঘাত হয়েছিল নিখিলেশ বাবুর মাথায়। বছর দুয়েক আগে নিখিলেশ বাবুর স্ত্রী শান্তা দেবীর সেরিব্রাল অ্যাটাক করে। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন ঠিকই, কিন্তু ডক্টর ফিজিও থেরাপি করতে বলে দেন। প্রতিদিনের মোটা খরচ ফিজিও থেরাপির পিছনে। সেই খরচ করতেও দ্বিধা বোধ করলেন না তিনি। স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলা প্রয়োজন। প্রত্যেক বিষম পরিস্থিতিতে একমাত্র স্ত্রীই তাঁর সাথে থেকেছেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না নিখিলেশ বাবু। ফিজিও থেরাপির কারণে তাঁর জমানো পুঁজি আসতে আসতে হয়ে যাচ্ছে শেষ। কিন্তু স্ত্রীর চিকিৎসাও তিনি বন্ধ করতে পারেন না। অবশেষে অনেক ভেবে একটি উপায় বের করলেন তিনি।সারা জীবন শাড়ির দোকানে সেলসম্যানের কাজ করেছেন তিনি। লেখাপড়ার দিকে ঝোঁক ছোট থেকেই। কম বয়সে পিতৃহারা হওয়ার কারণে সংসারের হাল সামলাতে শাড়ির দোকানে কাজে ঢুকেছিলেন নিখিলেশ বাবু। তিনি যে সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু হাজারও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি ছাড়েননি নিজের সাধনা। হ্যাঁ সাধনা, সাহিত্য সাধনা, কবিতার সাধনা। ষোলো বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লেখেন। দুর্ভাগ্যবশত কোনও দিন কোনও পত্রিকায় তিনি কবিতা পাঠাতে পারেননি। মাঝে – মাঝে কবিতা লেখা কাগজগুলো মনে হয়েছে জঞ্জাল। ইচ্ছে করেছে ছিঁড়ে ফেলে দিতে। নিখিলেশ বাবুর সংযম সব থেকে বড় গুণ। এই সংযমের কারণেই তাঁর লেখা কবিতা এখনও তাঁর কাছেই আছে।
রোদের তাপ বাড়তে শুরু করেছে আসতে আসতে। মাটিতে বসে আছেন নিখিলেশ বাবু। তাঁকে গোল করে ঘিরে বেশ কিছু লোকের ভিড়।
নিখিলেশ বাবুর সামনে ছড়ানো আছে কাগজের মেলা। এই কাগজের টুকরোই তিনি নিয়ে আসেন রোজ সকালে থলি করে। এতেই আছে নিখিলেশ বাবুর স্বরচিত বহু সংখ্যক কবিতা।
একটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে কবিতা পাঠ করতে শুরু করলেন তিনি –
“বয়স ভারে ন্যুব্জ হতেই পারি
কিন্তু তবু থামেনি কলম আমার,
ভাগ্য আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাতেই পারে
তবু ঘুরে দাঁড়িয়েছি বারবার।।
সমস্যারা গিঁট খুলে লুটিয়ে পড়েছে পায়ে
আর নিঃসীম অন্ধকারে ডুবে গেছি আমি,
তবুও হার মানিনি কখনোই,নিজেকে কতটা
গ্রহণযোগ্য করেছি,
তা জানে অন্তর্যামী।।”
কবিতা পাঠ করে আমদানি হয় করতালি এবং কিছু অর্থ। সকাল দশটা পর্যন্ত বেশ অনেক গুলোই কবিতা পাঠ করলেন তিনি। তার পর সব গুছিয়ে, আমদানি করা অর্থ নিজের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বাড়ির দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে গেলেন তিনি। ফিজিও থেরাপিস্ট আসার সময় হয়ে গেছে যে।
#বিশেষ_দ্রষ্টব্য :- গল্পে উল্লেখিত কবিতা কবি শ্রীমতী পারমিতা ভট্টাচার্যর লেখা। কবি পারমিতা ভট্টাচার্য কে অসংখ্য ধন্যবাদ।